জলছায়া 

ফায়াজ হাসান মাহি


(৯)

 টুম্পা আমার হাত ধরে বললো, ভাই বিশ্বাস করেন আমি

খারাপ মেয়ে না। আমার আব্বা স্কুল টীচার ছিলো।

আপনের বন্ধু আমারে ফুসলায় ঢাকা নিয়ে আসছে।

আমারে মারছে, নির্যাতন করছে। এই বাচ্চা ওর। আমি

বাচ্চা নিতে চাইনি। ও জোর কইরা আনছে। হেয়

নেশা করে, আমি ভয় পাইতাম বাচ্চা হইলে বেইচ্চা

দিবো। ভাই, আপনে আমার আপন ভাই। বিশ্বাস করেন

আমি নষ্ট বেটী না। আমার বাপের কাছে যাওয়ার মুখ

নাই। আমারে ঘরে নিবোনা কেউ। আমি কই যামু?

আমার বাচ্চা কই যাবে?

আমি কিছু চিন্তা না করে বললাম, আমার বাড়ি কুমিল্লায়।

আপনি আমাদের বাসায় থাকবেন। আমার বাবা মা অনেক

ভালো মানুষ। আপনি এখন একজন মা এবং আপনি একটা

ফুটুফুটে কন্যাকে জীবন দিয়েছেন। এর থেকে

গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীতে এখন এই মুহুর্ত থেকে আর

কিছু নাই। আপনার বাবার সাথে আমার বাবা মা কথা বলবে।

ছোটনকে আমি পুলিশে দিবো। সে যা করেছে

তার শাস্তি সে পাবে।

আমি বুঝতে পারছিলাম টুম্পা আমার কথা কিছুই শুনতে

পাচ্ছেনা। আমি বাহিরে বের হয়ে মেসের পথে

হাটা দিলাম। বাবা মা কে বললে আমি নিশ্চিত তারা আপত্তি

করবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে মেসে ঢুকে মনে

হলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। ১০ মিনিট পর

বুঝতে পারলাম, আসলেও সমস্যা হয়েছে। আমার

পাসপোর্ট ছোটন নিয়ে গেছে। টাকা পুরাটা

নেয়নি। ল্যাপটপটাও নিয়ে গেছে। আমি

ছোটনকে ফোন দিলাম, সে একবারেই ফোন

ধরলো। আমি ওকে শুধু বললাম, তুই আমার সব

রেখে দে। শুধু আমার পাসপোর্টটা ফেরত দিয়ে

যা।

ছোটন বারবার কসম খেয়ে বললো, বিশ্বাস কর

দোস্ত আমার আগের অভ্যাস নাই। তোর

পাসপোর্ট দিয়া আমি কি করবো? আমি একটা কাজ করি।

তোর মেসে পরের সপ্তাহে আসতেছি। আইস্যা

ঠিকমত কথা বলতেছি।

আমি বললাম, শোন তুই আমার পাসপোর্ট বিক্রি করে

যেই টাকা পাবি তার থেকে বেশি টাকা আমি তোকে

দিতে পারবো। আমার কাছে আরেক বন্ধুর কিছু টাকা

আছে। ওটা তুই নে। তোকে আমি ৫০ হাজার টাকা

দিচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি তোর টাকা লাগবে। তুই

এসে নিয়ে যা। কিন্তু পাসপোর্টটা খুব জরুরী

লাগবে বন্ধু। প্লীজ এটা দিয়ে যা।

ছোটন অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। আমাকে

ফ্যাস ফ্যাস করে বললো, আচ্ছা আমি তোর বাসায়

আসতেছি।

আমি কাকুতি মিনতি করে বললাম, পাসপোর্টটা আছে

তো?

সে একটু লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো, আচ্ছা

থাকবো। তুই থাক। আমি রাত্রি ১০টায় আসতেছি।

সন্ধ্যা সাতটায় আলমেরিনা নার্সিং হোম এন্ড হসপিটাল,

বাড্ডায় পৌছালাম। আমার কাছে যা টাকা ছিলো তার সাথে

মেসের পাশের রুমের মেরাজ ভাইয়ের থেকে

কিছু টাকা নিয়ে নার্সিং হোমের বিল দিতে এসেছি।

আসার পথে বারবার বাচ্চাটার চেহারা চোখে

ভাসছিলো। নার্সিং হোমের সাথে লাগানো

ফ্ল্যাডলাইটের আলোয় যখন বাচ্চার দুমড়ে মুচড়ে

যাওয়া নিথর দেহটা দেখলাম তখনও হলদেটে বাচ্চাটার

হাসির ছবিটা আমার কল্পনা থেকে মুছে যাইনি। পাশেই

ওর মা পড়ে ছিলো।দূর থেকে দেখলেও আমি

বুঝতে পারছিলাম, একটা অসহায় বাংলাদেশের

আরেকবার আজকে মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দিন হয়,

আজকেও হয়েছে। নতুন কিছু না। আমি তবুও

হাসপাতালে যাই। তাদেরকে অনেক সাধাসাধি করেও

বিলটা দিতে পারিনি।রাস্তায় লোকজনের অনেক

অনেক গুঞ্জন ঠেলে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায়

যাই। ছোট্ট আত্রলিতাকে রেখে আসতে মন

চাচ্ছিলোনা। আহারে বাচ্চাটা কি কখনো বুঝতে

পেরেছিলো কি অভিমানে তাকে নিয়ে তার মা

শূন্যের পথে হাত বাড়িয়েছিলো? নয়টা মাস গর্ভে

রাখা স্বপ্নটাকে নিয়ে একটা মা যখন আত্নহত্যা করতে

চাচ্ছিলো, ঠিক কেমনটা ছিলো সেই সময়ের

অদ্ভূত পৃথিবীর বিকেলটা?

{ প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের কোন এক কল্যাণপুর

গ্রামের সীমা আখতার নামে একটি মেয়ে উপরের

লেখার মতই তার তিনদিনের বাচ্চাকে নিয়ে অনেক

অভিমানে আত্নহত্যা করেছিলেন। সেই মায়ের

ভুলশুদ্ধ নিরুপনে আমরা জটিল পরিশ্রম দিয়েছিলাম,

সমাজ ও ধর্মমতে তার পাপের বোঝা মাপতেও

অনেকে ব্যস্ত ছিলাম। আফসোস, কেউ তাদের

ভালোবাসেনি। না মৃত্যুর আগে, না পরে। কেউ না। }

ছোটন সেই রাতে আমাকে পাসপোর্ট ফেরত

দিতে এসেছিলো। আমি ওকে টাকা না দিয়ে

একপ্রকার জোর করে ধরে ওর বাচ্চার লাশের

কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তখনো অনেক লোক

সেখানে জমা ছিলো। ওকে বাচ্চার লাশ দেখিয়ে

জমায়েত হওয়া জনতার কাছে ছেড়ে দিয়েছিলাম।

সবাই যখন ওকে মারছিলো ও চিৎকার করে

বলছিলো, দোস্ত আমারে মাইর্যান ফেলবো?

পিছনে ফিরে দেখি ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের

হচ্ছে। পুলিশ ওকে জনতা থেকে উদ্ধারের খুব

একটা চেষ্টা করছেনা। কি অদ্ভূত ওর রক্তাক্ত চেহারা

দেখে আমার ওর জন্য করুণা হচ্ছিলো। একসময়

ওকে আমি মানুষ ভাবতাম। ওর মা মারা যাওয়ার পর ও প্রায়

দিন আমাদের বাসায় এসে খাবার খুজতো। আমি সেই

কঠিন সময়ে ওকে কথা দিয়েছিলাম, যেকোন

অবস্থায় আমি ওকে সাহায্য করবো। আজ সেই

রক্তমাখা ছোটনকে দেখে বুঝলাম, নষ্ট সমাজে

কবেই তার মৃত্যু হয়েছে। আমি বোকা মানুষ এটা

কেন যেন বুঝতেই পারিনি।




জলছায়া -পর্ব-৭।ফায়াজ হাসান মাহি। বাংলা গল্প