জলছায়া
ফায়াজ হাসান মাহি
(৮)
হাসপাতালে ছোটনের মেয়েকে দেখে মনটা
শান্ত হয়ে গেলো। জন্মের পর বাচ্চারা সাধারণত ঘুম
ঘুম ভাব নিয়ে থাকে। এই বাচ্চাটা অন্যরকম। সে বড়
বড় গোল চোখে তাকিয়ে দেখছে সবাইকে।
আমার ভুল না হলে তার সাথে মজা করলে সে হাল্কা
করে ঠোট বাকিয়ে হাসি দেয়। আমি ছোটনকে
বললাম, মহাশ্বেতা। এক বিখ্যাত লেখিকার সম্মানার্থে
নামটা দিলাম। আমার খুব প্রিয় লেখিকা। তোর বউকে
জিজ্ঞাসা কর রাজী আছে কিনা?
ছোটনের বউয়ের নাম টুম্পা। মেয়েটার সারাটা মুখ
জুড়ে ক্লান্তি। চোখ দেখে মনে হয় লজ্জায়
কুঁকড়ে আছে নতুন আগন্তুক আসার অপরাধে। আমি
তার পাশে যেয়ে বললাম, ভাবী আপনি কি খুব চিন্তিত?
ছোটন সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। টেনশন
নিয়েন না।
টুম্পা কিছু বললোনা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো
শুধু। মেয়েটার বয়স আন্দাজ ১৬ কি ১৭ হবে। কিন্তু
বোঝা যাচ্ছে এই অসহনীয় সমাজে সে হাজার
বছরের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা
দীর্ঘশ্বাসের শব্দে যেন সে অনেকগুলো
গল্প বলে ফেললো। এই দেশে গরীব ঘরের
মেয়েরা গেরস্থের উঠোনে বিছানো পাটির মত।
যখন প্রয়োজন শক্তিশালী সমাজ তাতে পা মুছে
চলে যায়। ছিড়ে যাক ভেঙ্গে যাক, তার ব্যবহার
কমবেনা। কিন্তু দিন শেষে কেউ সেই পাটিতে
লেগে থাকা ময়লাটা মুছে দিয়ে যায়না, যত্ন তো
দূরের কথা। মোসাম্মাত টুম্পার জীবনটা হয়তো
এমনটাই ছিলো। তার চোখে আছে সামনে অনাগত
ভবিষ্যতের ভয় আর হৃদয়ে ছোট্ট আত্রলিতার হামি
দেয়া গুঞ্জনের অপ্রকাশিত আনন্দবার্তা।
ছোটন তার বউকে কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো,
আমি হাসপাতালের বিল দিয়া আসতেছি। তু্মি একটু
অপেক্ষা করো। আজকেই তোমারে নিয়া যামু।
টুম্পা কিছু বললোনা। ও চলে যাওয়ার পর হঠাৎ কান্না শুরু
করলো।আমি কিছু না বুঝে বাহিরে দাড়িয়ে থাকলাম।
একটু পর টুম্পার ফুফু এসে বললো, তোমার বন্ধু
তো আর আইবোনা। হেয় কি টাকা পয়সা নিয়া
আসছিলো? দুইদিন ধইরা মাইয়াটা এহানে আটকায়
পইড়্যা আছে। ওই পোলা হইলো নেশাখোর। টাকা
পাইলে নেশা ছাড়া আর কিছু করেনা।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, আমি ওকে কিছু টাকা
দিয়েছি। ও বিল দিয়ে এখুনি এসে পড়বে। আপনারা
আরেকটু অপেক্ষা করেন।
বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। এরপর
ছোটনের বউকে যেয়ে বললাম, ওকে কি একটা
ফোন করবেন।
টুম্পার শ্বাশুড়ি বললো, অনেকবার ফোন দিছি।
ধরেনা। আপনে একবার দেন। বাচ্চার গায়ে জ্বর
আইছে।
আমি টুম্পার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি এতো চিন্তা
করবেন না। আমি ছোটনকে ফোন দিচ্ছি। ওর
তো এতো দেরী করার কথা না।
আমি ছোটনকে তিনবার ফোন দিলাম। একবারও
ফোন ধরলোনা। চতুর্থবার সে ফোন ধরে
নেশাগ্রস্ত গলায় বললো, দোস্ত আমি আইতেছি
তোর বাসায়। তুই কই?
আমি মেজাজ শান্ত করে বললাম, ছোটন তুই
হাসপাতালের বিলটা দিয়ে তোর বউকে নিয়ে যা।
একটু পর পর আয়া টাইপ কিছু মানুষ এসে জঘণ্য ভাষায়
কথা বলছে বেড খালি করার জন্য।
ছোটন চুক চুক করে বললো, দোস্ত তোরে
আসলে বলা হয়নাই। এই মাগীর পয়দা যেইটা হইছে
ওইটা আমার না। আজকে চেহারা দেইখ্যা শিউর হইছি।
এইজন্য রাগ কইর্যা আর আসিনাই। দোস্ত তুই চইল্যা
আয়। এই মাগী ওর পুরুষরে ডাইক্যা বাচ্চা ক্লিয়ার
কইরা দিবো।
আমি হতভম্ব হয়ে ওর কথা শুনছিলামশ। একটু পর আবার
ও বললো, দোস্ত তুই একটা কাম কর। তুই মাগীরে
ফোন দে।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা দিলাম ওর বউকে। ওর
বউকে কি বললো ও জানিনা। ওর বউ ফোনে
অঝোরে কান্না শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে
বললো, তোর মত বেজন্মার বাচ্চা আমি রাখমুনা।
প্রায় ১৫ মিনিটের মত আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
কি বলবো এই পরিস্থিতে বুঝতে পারছিলাম না। আমি
অনেক ভেবে টুম্পাকে বললাম, দেখুন আমার বন্ধু
আপনাকে কি বলছে আমি জানিনা। সে আপনার কি হয়
তাতেও আমার যায় আসেনা। আমি বিল দিয়ে
আপনাদের হাসপাতাল থেকে ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা
করছি।
(চলবে...)
জলছায়া-পর্ব ৭। ফায়াজ হাসান মাহি।বাংলা গল্প
জলছায়া- পর্ব ৬। ফায়াজ হাসান মাহি।বাংলস গল্প
0 Comments